কিডনি রোগের লক্ষণ

কিডনি রোগ মানবদেহের একটি গুরুতর সমস্যা হতে পারে, যার প্রাথমিক লক্ষণগুলো খুবই সূক্ষ্ম ও গোপন থাকে, তাই প্রাথমিক অবস্থায় বুঝতে পারা কঠিন। তবে কিছু বিশেষ লক্ষণ আছে, যেগুলি পর্যবেক্ষণ করলে কিডনি সমস্যার সম্ভাবনা আঁচ করা যেতে পারে। এই রোগের প্রাথমিক উপসর্গগুলো প্রায়ই শরীরের অন্য কোনো সমস্যা হিসেবে ধরা পড়ে, যার ফলে মানুষ সহজে এগুলোর প্রতি নজর দেয় না। কিন্তু যদি আপনি নিচের পাঁচটি লক্ষণ লক্ষ্য করেন, তবে সতর্ক হওয়া উচিত, কারণ এগুলো কিডনি রোগের পূর্বাভাস হতে পারে।

প্রথমত, ফোলাভাব খুবই সাধারণ একটি উপসর্গ, বিশেষত মুখ, চোখের নিচে, পায়ের গোড়ালি বা শরীরের অন্যান্য অংশে অস্বাভাবিক ফুলে ওঠা। কিডনি যখন শরীর থেকে অতিরিক্ত পানি বের করতে ব্যর্থ হয়, তখন তা শরীরের বিভিন্ন অংশে জমে গিয়ে ফোলাভাব সৃষ্টি করতে পারে। যদি এই ফোলাভাব স্থায়ী হয়ে যায় এবং এক সপ্তাহ বা তারও বেশি সময় ধরে চলতে থাকে, তবে তা কিডনি সমস্যার লক্ষণ হতে পারে।

দ্বিতীয়ত, ক্লান্তি বা অস্বাভাবিকভাবে দুর্বল অনুভূতি দেখা দিলে তা কিডনি রোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ। কিডনি ঠিকমতো কাজ না করলে রক্তে বিষাক্ত উপাদান জমে যেতে পারে, যা রক্তস্বল্পতা সৃষ্টি করে এবং শরীরের শক্তি কমিয়ে দেয়। এর ফলে ক্লান্তি এবং দুর্বলতার অনুভূতি বাড়তে থাকে। কিডনি সঠিকভাবে কাজ না করলে শরীরের সঠিক পরিশোধন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়, যার ফলস্বরূপ আপনি সবসময় ক্লান্ত ও দুর্বল অনুভব করবেন।

তৃতীয়ত, প্রস্রাবের সমস্যা কিডনি রোগের আরেকটি সাধারণ উপসর্গ। যদি আপনাকে নিয়মিতভাবে বেশি প্রস্রাব করতে হয় বা একেবারে কম প্রস্রাব হয়, তবে এটি কিডনি সমস্যার সূচক হতে পারে। এছাড়া, মূত্রে রক্ত বা অতিরিক্ত ফেনা দেখা, বা প্রস্রাবের মধ্যে অস্বাভাবিক গন্ধ থাকা কিডনি সমস্যার লক্ষণ হতে পারে। বিশেষ করে রাতে বেশি প্রস্রাব করার সমস্যা হলে, এটি কিডনি রোগের ইঙ্গিত হতে পারে।

চতুর্থত, শ্বাসকষ্ট কিডনি সমস্যার কারণে হতে পারে, কারণ কিডনি শরীরের তরল ভারসাম্য বজায় রাখে। যখন কিডনি সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না, তখন শরীরের তরল ফুসফুসে জমা হতে শুরু করে, যার ফলস্বরূপ শ্বাসকষ্ট সৃষ্টি হয়। এই সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তির মাঝে ফ্লুইড ওভারলোড বা হাইপারভোলেমিয়া দেখা দিতে পারে, যা শ্বাসকষ্ট এবং বুকের ব্যথা সৃষ্টি করতে পারে।

পঞ্চমত, অনিদ্রা বা ঘুমের সমস্যা কিডনি রোগের একটি অন্যতম লক্ষণ। কিডনি যখন শরীর থেকে পানি বের করতে পারে না, তখন কিছু পানি ফুসফুসে জমে যেতে পারে, যার ফলে রাতে ঘুমানোর সমস্যা হতে পারে। কিডনির অসুখে আক্রান্তদের মাঝে সাধারণত ঘুমের সমস্যা দেখা যায়, যা তাদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার ওপর প্রভাব ফেলে।

কিডনি রোগের এই লক্ষণগুলো যদি পর্যবেক্ষণ করা হয়, তবে তা রোগটির প্রাথমিক ধাপেই সনাক্ত করা সম্ভব হতে পারে। তবে যেকোনো ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিলে একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সময়মতো চিকিৎসা গ্রহণ করলে কিডনি রোগের গম্ভীরতা অনেকটাই কমানো সম্ভব।

খেজুর খাওয়ার উপকারিতা

কিডনির সমস্যা হলে কোথায় কোথায় ব্যথা হয়

কিডনি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, যা শরীরের অবশিষ্ট বর্জ্য, অতিরিক্ত পানি এবং সঠিক পরিমাণে ইলেকট্রোলাইট নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। কিডনি যখন ঠিকভাবে কাজ না করে, তখন শরীরে বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দিতে পারে। এই উপসর্গগুলো অনেক সময় একে অপরের সাথে মিলিত হয়ে কিডনির সমস্যার সংকেত দেয়। কিডনি রোগের কারণে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যথা হতে পারে, যা রোগীকে একাধিক শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন করে। কিডনির সমস্যার কারণে শরীরের কোথায় কোথায় ব্যথা অনুভূত হতে পারে, তা নিম্নে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো।

কিডনি রোগের সবচেয়ে সাধারণ এবং প্রবণ লক্ষণগুলির মধ্যে একটি হলো কোমরের দুই পাশে ব্যথা। কিডনি সংক্রমণ বা পাথর তৈরি হলে এটি কোমরের নিচের দিকে, বিশেষ করে কিডনির অবস্থান অনুযায়ী ব্যথা সৃষ্টি করতে পারে। এই ব্যথাটি তীব্র হতে পারে এবং অনেক সময় দীর্ঘস্থায়ী হয়ে যায়। কখনও কখনও এই ব্যথা তলপেটেও অনুভূত হতে পারে। কিডনি পাথর বা সংক্রমণের কারণে মূত্রনালির ব্যথা বা ব্লাডারের সমস্যা হলে, তাও কোমরের দুই পাশে ব্যথা সৃষ্টি করতে পারে। এই ব্যথা অনেক সময় প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে এবং চলাফেরা করতে অসুবিধা হতে পারে।

কিডনি রোগের কারণে প্রস্রাবের সমস্যা হতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে প্রস্রাবের রং পরিবর্তন, প্রস্রাবে জ্বালা, বা ব্যথা অনুভব করা। অনেক সময় কিডনি সংক্রমণের কারণে প্রস্রাবের রং লালচে বা মাটির মতো দেখা যেতে পারে, যা কিডনির ক্ষতি হওয়ার প্রাথমিক লক্ষণ। এছাড়া, প্রস্রাবে অতিরিক্ত ফেনা দেখা যাওয়াও কিডনি রোগের একটি লক্ষণ হতে পারে, কারণ কিডনি সাধারণত শরীরের প্রোটিন নিয়ন্ত্রণ করে, কিন্তু যখন কিডনি সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না, তখন এই প্রোটিন শরীরের বাইরে চলে যায়। কিডনি সমস্যার কারণে মূত্রনালিতে ব্যথাও হতে পারে, যা সাধারণত পায়ের নিচের অংশে বা তলপেটে অনুভূত হয়।

শরীরের বিভিন্ন অংশে ফোলাভাব হওয়া কিডনি রোগের আরেকটি পরিচিত লক্ষণ। কিডনি সঠিকভাবে পানি বের করতে না পারলে শরীরে পানি জমে যেতে পারে, যার ফলে পা, হাত, মুখ, বা চোখের নিচে ফুলে ওঠা দেখা যায়। কিডনির কার্যকারিতা কমে গেলে এই ফোলাভাব স্থায়ী হয়ে যেতে পারে এবং শরীরে অতিরিক্ত পানি জমে থাকে। এই অবস্থায় শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে, ফলে শরীরের বিভিন্ন অংশে অস্বস্তি এবং ব্যথা অনুভূত হতে পারে।

কিডনির সমস্যা আরও এক ধরনের ব্যথার কারণ হতে পারে, তা হলো মাংসপেশির টান বা খিঁচুনি। কিডনি সঠিকভাবে কাজ না করলে শরীরের ইলেকট্রোলাইট ভারসাম্য বিঘ্নিত হতে পারে। এই ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতা শরীরের মাংসপেশিতে টান লাগানোর মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে, যার ফলে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়। এটি বিশেষ করে পেশীতে টান বা আঘাতের মতো অনুভূতি দেয় এবং কখনও কখনও শরীরের অন্যান্য অংশে সেলফের ব্যথার সাথে যুক্ত হয়ে আরও তীব্র হয়ে যেতে পারে।

বিভিন্ন স্থানে চুলকানি বা ত্বকে র্যাশও কিডনি রোগের একটি লক্ষণ হতে পারে। কিডনির সমস্যা হলে শরীরের টক্সিন সঠিকভাবে পরিশোধিত হতে পারে না, ফলে ত্বকে অস্বস্তি সৃষ্টি হয়। ত্বকে চুলকানি, র্যাশ বা শুষ্কতা দেখা দিতে পারে, যা কিডনির কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ার একটি লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

একইভাবে, ক্লান্তি এবং দুর্বলতা কিডনি সমস্যার আরেকটি গুরুতর লক্ষণ। যখন কিডনি ঠিকভাবে কাজ না করে, তখন শরীরের বর্জ্য এবং বিষাক্ত উপাদান শরীরের বিভিন্ন স্থানে জমে যায়, যার ফলে ক্লান্তি এবং দুর্বলতা দেখা দেয়। এই ক্লান্তি সাধারণত দীর্ঘ সময় ধরে থাকে এবং অবসাদ তৈরি করে। শরীরের অভ্যন্তরীণ কাজের অক্ষমতা ও টক্সিনের জটিলতা যেহেতু বেড়ে যায়, তাই রোগী সারা দিন ক্লান্ত অনুভব করতে পারেন।

কিডনি রোগের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো এর দীর্ঘমেয়াদি অবস্থা, যা ক্রনিক কিডনি ডিজিজে পরিণত হয়। যদি ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা দীর্ঘস্থায়ী কিডনি সংক্রমণ ঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না হয়, তবে কিডনি সঠিকভাবে কাজ করা বন্ধ করে দেয় এবং কিডনি নষ্ট হতে পারে। কিডনি সমস্যা হলে শরীরের যেকোনো অংশে ব্যথা এবং অস্বস্তি দেখা দিতে পারে, যার কারণে চিকিৎসা না করালে রোগ আরো গুরুতর হয়ে উঠতে পারে।

ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিডনির সমস্যার লক্ষণ দেখলে কোনো ধরনের ওষুধ বা চিকিৎসা নিজেই শুরু করা উচিত নয়, কারণ ব্যথানাশক ওষুধ বা অ্যান্টিবায়োটিক শরীরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ধরনের ওষুধ খাওয়া উচিত নয়, কারণ এ ধরণের ওষুধ কিডনির কার্যক্ষমতা আরো কমিয়ে দিতে পারে।

এছাড়া, যদি দীর্ঘসময় ধরে কিডনিতে পাথর বা ইউরিন ইনফেকশন থাকে, তবে তা সঠিকভাবে চিকিৎসা করা প্রয়োজন। এই অসুখগুলো অমীমাংসিত অবস্থায় রেখে দিলে কিডনি আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। নিয়মিত শরীরচর্চা, সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসার মাধ্যমে কিডনির সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

কিডনি সুস্থ রাখতে হলে প্রতিদিন পর্যাপ্ত পানি পান করা, লবণ এবং চর্বিযুক্ত খাবার কম খাওয়া, নিয়মিত এক্সারসাইজ এবং পর্যাপ্ত ঘুম এসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোর মাধ্যমে কিডনির কার্যক্ষমতা বজায় রাখা সম্ভব এবং কিডনি সমস্যার ঝুঁকি কমানো যায়।

By SAGDOM

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *